সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো

Hits: 6

রাখী সাহা : কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা হিসেবে ধরা হয় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের পুজোকে ।
এই পুজো শুরু হয় জমিদার লক্ষীকান্ত রায় চৌধুরী এবং তার স্ত্রী ভগবতী দেবীর হাত ধরে ১৬১০ সালে বর্ধিষ্ণু গ্রাম বড়িশাতে । সেই সময় ভারতবর্ষে ছিল মুঘল যুগ , তখন হিন্দু-মুসলমান প্রজা এই গ্রামের সুখে শান্তিতে আনন্দে পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করতেন । এই সময়ে জমিদার লক্ষীকান্ত রায় চৌধুরী বড়িশা গ্ৰামে তার নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করলে সকল প্রজা একসঙ্গে মিলেমিশে এই পুজোয় সামিল হয় । কিছু কিছু গবেষকের মতে লক্ষীকান্তের আগেও বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল । তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ন এবং ভাদুড়িয়ার রাজা জগৎ নারায়ণ বাংলায় দুর্গা পুজোর প্রচলন করেছিলেন কিন্তু তা মা চন্ডীর আরাধনা । সপরিবারে প্রথম মা দুর্গার আরাধনা শুরু করেন লক্ষীকান্ত রায় চৌধুরী।

বড়িশার বাড়িতে হোগলা পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির মন্ডপ তৈরি করে সেখানেই মা দুর্গার আরাধনা শুরু করেন লক্ষীকান্ত ও তার ধর্মপ্রাণা স্ত্রী । পরে বড়িশার এই বাড়িতে এইখানেই তৈরি হয়েছে আটচালা মন্দির । এখনো এই বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয় ঠিক আগের মতো করেই । তবে দিন যত এগিয়েছে পরিবার আস্তে আস্তে তত‌ই বড় হয়েছে তখন আর একটি নয় বরং ১০ – ১১ টি পরিবারে মায়ের পুজো হতে শুরু করে। তবে এখন আটটি বাড়িতে পুজো হয়ে থাকে। এগুলি হলো – আটচালা বাড়ির পুজো , বড়ো বাড়ির পুজো , মেজো বাড়ির পুজো , মাঝের বাড়ির পুজো , বেনাকি বাড়ির পুজো, কালীকিঙ্কর ভবনের পুজো, এছাড়াও বিরাটি বাড়ি ও নিমতা বাড়ির পুজো।

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় সাবেকি মতে বিদ্যাপতি রচিত
‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’র রীতি নিয়ম অনুসারে। পরে অবশ্য নিয়মে কিছুটা পরিবর্তন আনেন লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরীর নাতি বিদ্যাধর রায় চৌধুরী। তার সময় থেকেই রায় চৌধুরী পরিবারে শাক্ত , শৈব ও বৈষ্ণব
এই ত্রিধারাসঙ্গমে পুজো শুরু হয়, যা আজও হয়ে চলেছে।

পুরনো রীতি মেনেই প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর দিন ঠাকুরদালানে অনুষ্ঠিত হয় কাঠামো পুজো । আর তার পরের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা তৈরীর কাজ । প্রতিমা তৈরি হয় মঠচৌড়ি বা তিনচালিতে । একচালার প্রতিমায় মা দুর্গার সঙ্গে থাকেন লক্ষ্মী , সরস্বতী , গনেশ , কার্তিক । এছাড়াও কার্তিকের রাজবেশের
ধারণাটিও এখান থেকেই এসেছে । প্রতিমার দু’পাশে থাকেন মহাদেব ও নারায়ণ । এখানে বছরের পর বছর ধরেই একই কাঠামোয় পুজো হয়ে আসছে । প্রতি বছর প্রতিমা নিরঞ্জনের পর কাঠামোটি জল থেকে তুলে সযত্নে রাখা
হয় । সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে মা দুর্গার গায়ের রং শিউলি ফুলের বোঁটার মতো । গনেশের গায়ের রং লাল এবং অসুরের গাত্রবর্ণ হয় সবুজ । চালচিত্রে আঁকা থাকে দশমহাবিদ্যা ও রাধাকৃষ্ণের
ছবি ।

একমাত্র নিমতার বাড়ি ছাড়া বাকি সব বাড়িতেই মাকে পুজোয় আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। সন্ধি পুজোর সময় শোল বা ল্যাঠা মাছ পুড়িয়ে মাখনে ডুবিয়ে মাকে নিবেদন করা হয় ।
এ বাড়ির ভোগ রান্নার একটা নিয়ম আছে । সন্ধিপুজো শুরু হলে সদ্য স্নান করে ভিজে কাপড়ে ভোগ রান্না করতে হয় ‌।

দশমীর দিন সকালে ঠাকুরের ঘট বিসর্জনের পর ঠাকুর দালানেই ঘরের তৈরি বোঁদে মুখে দিয়ে সারা হয় বিজয়া ।

বনেদিয়ানা ও ঐতিহ্যের মিশেলে
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজোর আকর্ষণ অনস্বীকার্য। প্রতি বছর এই পুজো দেখতে দুর দুরান্ত থেকে বহু মানুষের সমাগম ঘটে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *